সাঁওতাল বিদ্রোহ

সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ

  • খাজনা ও উপশুল্ক আরোপ : আদিবাসী সাঁওতালরা ছোটোনাগপুর, পালামৌ, মানভুম, রাঁচি, হাজারিবাগ, বীরভূম, বাঁকুড়া ও মেদিনিপুরের বিস্তীর্ণ বনভুমি অঞ্চলে বাস করত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সাঁওতালরা বাধ্য হয়ে এসব অঞ্চল ছেড়ে ব্রিটিশের খাস এলাকা রাজমহলের পার্বত্য সমতলভূমিতে ( ভাগলপুর অঞ্চল ) এসে বসবাস শুরু করে । এখানকার বনাঞ্চল পরিষ্কার করে ও পাথুরে জমিকে আবাদি জমিতে পরিণত করে তারা অঞ্চলটির নাম দেয় ‘দামিন – ই – কোহ’( পাহাড়ের প্রান্তদেশ )। কিন্তু এখানেও কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করে বিভিন্ন খাজনা ও উপশুল্ক আদায় শুরু করলে সাঁওতালরা হুল(হূল কথার অর্থ বিদ্রোহ) বা বিদ্রোহ ঘােষণা করে ।
  • বন্ড প্রথা :পাকুর ও মহেশপুরের রাজারা বহিরাগত জমিদার ও সুদখাের মহাজনদের হাতে সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে লিজ দেয় । অভাবের তাড়নায় এইসব মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ ( খাদ্যশস্য বা অর্থ ) নিলে সাঁওতালদের কামিয়াতি ও হারওয়াহি নামক দু – ধরনের বন্ডে সই করতে হত । কামিয়াতি ব্যবস্থায় যতদিন না ঋণ নেওয়া সাঁওতাল দাদন শােধ দিতে পারত ততদিন তাদেরকে মহাজনের জমিতে বেগার খাটতে হত । আর হারওয়াহি ব্যবস্থার দাদন শােধ করতে ব্যর্থ সাঁওতালদের মহাজনদের জমিতে শ্রমদানের পাশাপাশি অন্যান্য কাজকর্মও করতে হত ।
  • রেলকর্মচারী ও ঠিকাদারদের অত্যাচার :লর্ড ডালহৌসির শাসনকালে রাজমহল , রামপুরহাট , ভাগলপুর , সাহেবগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চল দিয়ে রেললাইন পাতার কাজ শুরু হয় । বহু সাঁওতাল শ্রমিক নগদ মজুরির আশায় কাজে যোগ দেয়। কিন্তু ন্যায্য মজুরির চেয়ে তাদের অনেক কম মজুরি দেওয়া হত। এছাড়া সাঁওতাল শ্রমিকদের ওপর নানা ধরনের অত্যাচার শুরু হয়। এতে তারা ক্ষিপ্ত হয়।
  • ব্যবসায়ীদের কারচুপি : সাঁওতাল পরগনাতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সরলতা ও অশিক্ষার সুযােগ নিয়ে সাঁওতালদের ঠকাত । তারা বেচারাম বা ছােটো বাউ নামক বাটখারার দ্বারা হিসাবের কম ওজনের দ্রব্য বিক্রি করে সাঁওতালদের ঠকাত । আবার সাঁওতালদের কাছ থেকে কোনাে শস্য কেনার সময় হিসাবের থেকেও ভারী ওজনের কেনারাম বা বরা বাউ বাটখারা ব্যবহার করে বেশি পরিমাণ দ্রব্য ক্রয় করত । একসময় এই অসাধু ব্যবসায়ীদের কারচুপি জানতে পেরে সাঁওতালরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ।
  • অরণ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ : অরণ্যের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপও এই বিদ্রোহের এক প্রধান কারণ । ‘ Freedom Struggle ’ গ্রন্থে বিপান চন্দ্র , বরুণ দে ও অমলেশ ত্রিপাঠী বলেছেন যে , অরণ্যে সাঁওতালদের অধিকারকে কেন্দ্র করেই সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ।

বিদ্রোহের প্রসার ও দমন:

  • ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরবের নেতৃত্বে প্রায় ৪০ হাজার সাঁওতাল ভাগনাডিহির মাঠে মিলিত হয়ে ফুল বা বিদ্রোহের শপথ নেয়।
  • সাঁওতাল বিদ্রোহ বা হূলের প্রতীক ছিল শালগাছ।
  • বিদ্রোহের প্রথম দিকে বীর সিং, লিকা মাঝি, কালাে প্রামানিক, ডােমন মাঝি প্রমুখেরা নেতৃত্ব দেন।
  • ডালহৌসীর নির্দেশে ইংরেজ সেনাপতি জারভিস সাঁওতালদের দমন করেন। সাঁওতালরা দিঘি খানার অত্যাচারী দারোগা মহেশ লাল দত্ত এবং মহাজন কেনারাম ভগৎ কে হত্যা করেন।
  • ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ফরেস্ট অ্যাক্ট পাশ হয়। সাঁওতাল সমাজে মাঝি ও মুলিয়াদের বিশেষ অধিকারকে সরকার অস্বীকার করলে তারা খেরওয়ার আন্দোলন শুরু করেন।

সাঁওতাল বিদ্রোহের চরিত্র বা প্রকৃতি

  • চরিত্র বা প্রকৃতিগত বিচারে সাঁওতাল বিদ্রোহ একটি উপজাতি বিদ্রোহ হলেও এই বিদ্রোহ একটি কৃষক অভ্যুত্থানও বটে ।
  • এই বিদ্রোহ সাঁওতালদের কাছে স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ হলেও তাতে ব্রিটিশ সমর্থনপুষ্ট মহাজন , জমিদার , ঠিকাদার , নীলকর সাহেবদের শােষণের বিরুদ্ধে এক তীব্র জেহাদ ছিল ।
  • সাঁওতাল বিদ্রোহ শেষের দিকে কুমাের , কামার , গােয়ালা , চামার , তেলি , ডােমসহ বহু নিম্নশ্রেণির হিন্দু যােগ দিয়ে এই বিদ্রোহকে গণমুখী করে তুলেছিল ।

সাঁওতাল বিদ্রোহের গুরুত্ব বা ফলাফল

  • সাঁওতাল পরগনা গঠন :সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলেই ইংরেজ কর্তৃপক্ষ উত্তরে গঙ্গার কাছাকাছি তেলিয়া গড়াই পরগনার সঙ্গে বীরভূম ও ভাগলপুর থেকে ৯০০০ বর্গকিলােমিটার এলাকা জুড়ে একজন ডেপুটি কমিশনারের অধীনে সাঁওতালদের জন্য সাঁওতাল পরগনা নামে একটি স্বতন্ত্র সংরক্ষিত এলাকা সৃষ্টি করে । বলা হয় সাঁওতাল পরগনায় কোম্পানির কোনাে আইনবিধি কার্যকর করা হবে না ।
  • বিশেষ অধিকারের স্বীকৃতি : সমগ্র সাঁওতাল পরগনায় পুলিশ বাহিনীর বদলে মাঝি-পরগনাইত প্রভৃতি সাঁওতাল গোষ্ঠীপতিদের বিশেষ অধিকার স্বীকার করে নিয়ে তাদের ওপরই শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয় । সাঁওতালদের পৃথক উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ।
  • ইংরেজদের প্রবেশাধিকার :তিন বছরের জন্য ওই পরগনায় মহাজনদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয় । কিন্তু সেখানে ইউরােপীয় মিশনারিদের অবাধ প্রবেশের ব্যবস্থা করে সাঁওতালদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন এবং খ্রিস্টধর্ম প্রচারের নীতি গৃহীত হয় ।